যে দেশ কিনা রকেট ছোড়ে মহাকাশে , নোবেল আনে নানা বিষয়ে , বিশ্ব অর্থনীতিতে তাবড় তাবড় প্রথম সারির দেশকে ভাবতে বাধ্য করে ভারতের অবস্থান নিয়ে সেই দেশেই কিনা রোজ ভোরের আলো ফোঁটার আগে খোলা মাঠে , ঝোপে ঝাড়ে , রেললাইনের পাশে "ইয়ে " জমতে থাকে! ভারতবর্ষে পর্যটনের মূল কথা- " অতিথি দেব ভব :" তা অতিথিরা এসে যদি পথে-ঘটে এমন জিনিস দেখেন তাহলে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে যে গেলো গেলো রব উঠে যাবে তা নিয়ে বোধ হয় বিশেষ দ্বিমত নেই। তাছাড়া পরিবেশদূষণ আর রোগভোগের প্রকোপও বাড়তেই থাকবে বছরভর। ভবিষ্যৎ বিপদের অশনিসংকেত কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারেরই। স্বচ্ছ ভারত অভিযান এর কথাই
বলুন আর মিশন নির্মল বাংলার কথাই বলুন, মূল Agenda কিন্তু মুক্তোশৌচবিহীন সমাজ গড়ে তোলা। ১৯৭০ এর দশকে সুলভ শৌচাগার আন্দোলন এর মাধ্যমে যে কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল আজ সরকারি অর্থানুকুল্যে তাই মহীরুহের আকার নিয়েছে।প্রশাসনিক সহযোগিতায় সমাজকে নির্মল করে তোলার দায়িত্ত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন সমাজের সকল স্তরের মানুষ।সরকারি
কর্মচারী হিসেবে আমিও এই দিনবদলের সামান্য কারিগর। তাই অনেকের মতো আমার ও মনে হয়েছে ভারতের মতো দেশে এতো লোকসংখ্যার চাপ আর গড়পড়তা সাধারণ দিন আনি দিন খাই মানুষের জীবনযাত্রার নিম্নমান হয়তো অনেকটাই এই অভ্যাসের জন্য দায়ী।
কিন্তু ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে বারবার একটা প্রশ্ন মনে এসেছে যে স্মরণাতীত কাল থেকে কি এদেশে মানুষজন মুক্তশৌচেই অভ্যস্ত নাকি কখনো পাকা শৌচাগার ব্যবহারেরও প্রচলন ছিল। পুঁথিগত তথাকথিত ইতিহাসচর্চায় এবিষয়ে তেমন কোনো বিশদ তথ্য আমার স্বল্পবিদ্যায় ধরা দেয় নি। তবু যেটুকু কুড়িয়ে পেলাম সেটুকুই পাঠকের সাথে share করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
আপনারা হয়তো অনেকেই জানলে আশ্চর্য হবেন ( অন্তত আমি তো হয়েছি ) এই তথ্য জেনে যে আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছরেরও বেশি আগে বিশ্বের প্রাচীনতম Flush Toilet ব্যবহারের পুৰাতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে ইউরোপে বা চিনে নয় , মিশর বা মধ্য প্রাচ্যে নয়- আমাদের এই ভারতবর্ষে- হরপ্পা সভ্যতায়। সেই যুগে স্বচ্ছল গৃহস্থের বাড়িতে স্নান ও শৌচের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকতো। শৌচের জন্য থাকতো ইটের তৈরী গর্ত। শৌচাগারের পাশেই কুয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে যা থেকে ধারণা করা যায় কুঁয়ো থেকে জল এনে শৌচের পর জমে থাকা বর্জ্য ধুয়েঁ ফেলা হতো। সেই বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য আলাদা কাঁচা মাটির ইটের তৈরী নালা ছিল। প্রত্যেক বাড়ির সাথে যুক্ত ছোট ছোট নালাগুলো আবার শহরের মূল নালাগুলোর সাথে যুক্ত থাকতো। সেই নালা দিয়ে ময়লা এসে জমা হতো Soak-pit এ। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওই Soak-pit গুলো পরিষ্কার করা হতো নিয়ম করে। পশ্চিম ভারতে আমেদাবাদ থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে লোথালে মাটি খুঁড়ে যেসকল পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায় যে প্রত্যেক বাড়িতেই শৌচকার্য্যের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। বর্জ্যনিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত নালাগুলো পোড়া মাটির ইটের তৈরী ঢাকনা দিয়ে ঢাকা থাকতো যাতে কোনো ভাবেই সেখান দিয়ে নিষ্কাশিত বর্জ্য পরিবেশকে দূষিত করতে না পারে ও রোগজীবাণু ছড়াতে না পারে। পুরো শহরে নিকাষিব্যবস্থা সঠিক ভাবে নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষনের ব্যাপারে নগরকর্তৃপক্ষ কড়া নজরদারি চালাতেন। প্রয়োজনমাফিক পরিষ্কার ও মেরামতের জন্য ঢাকা দেওয়া manhole ও চেম্বার এর নিদর্শন ও পাওয়া গেছে। ২৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে যে অসামান্য বিজ্ঞানসম্মত Sanitary Engineering এর সাক্ষী হয়েছিল ভারতবর্ষ তা পরবর্তী কালে অনেকাংশেই হারিয়ে গিয়েছিলো কালের গর্ভে। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি থেকে উঠে আসে আরো একটি অবাক করা তথ্য। শহরের বড় রাস্তাগুলোর সমান্তরাল ভাবে মূল নালাগুলো পাতা থাকতো। নগরের বাইরে কৃষিক্ষেত্রগুলো যুক্ত হয়েছিল এই নালাগুলোর দ্বারা। এই বর্জ্যের একাংশ নগরবাসী সার হিসেবে ব্যবহার করতো ফসলোৎপাদনের জন্য। সুতরাং আজকের দিনে বিভিন্ন জায়গায় সরকারি বা কখনো কখনো বেসরকারি উদ্যোগে যে solid
& liquid waste management এর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ভারতবর্ষে কিন্তু তার সূচনা হয়েছিল আজ থেকে বহু বছর আগেই সেই সিন্ধু সভ্যতায়।
নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতাকে পিছনে ফেলে ভারতবর্ষ যত এগিয়ে এসেছে ততই এই বিষয়ে তথ্য প্রমান কমে এসেছে। অনেক ঐতিহাসিকই ৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালকে মনে করেছেন Human Hygieneএর ক্ষেত্রে Dark Age I সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তী প্রাচীন ভারতে মাটি দিয়ে বর্জ্য ঢেকেরাখার বা নদী নালার
জলে ভাসিয়ে দেবার তথ্য পাওয়া যায় যা অনেকটাই স্বাস্থ্যসম্মত বিজ্ঞানভিত্তিক হরপ্পা সভ্যতার শৌচব্যবস্থার পরিপন্থী। সমাজের প্রতিষ্ঠিত স্বচ্ছল পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ স্থানে শৌচের প্রথা থাকলেও নিকাশি ব্যবস্থা ভালো না হওয়াতে তা পরিবেশকে একই ভাবে দূষিত করতো। পন্ডিত বাণভট্টের লেখা কাদম্বরী থেকে জানা যায় গুপ্তযুগে রাজপরিবারের জন্য আলাদা শোচাগারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে শৌচকর্মের জন্য কাঠের তৈরী সিট এবং সাধারণ মানের পিটের ব্যবহারের কথা জানা যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রথম পাকা শৌচাগার ব্যবহারের বিষয়ে জোর দেন। তিনি ঘোষণা করেন একশো পরিবারপিছু অন্তত একটি করে পাকা শৌচাগার তৈরী হলে সরকারি অর্থ সাহায্য পাওয়া যাবে। এইভাবেই বোধ হয় প্রথম ভারতবর্ষে Public Toilet ব্যবহারের সূত্রপাত হয়। মুঘল আমলে এগুলিকে বলা হতো "গোসলখানা" I কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক দেখভাল ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অচিরেই শৌচালয়গুলি পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং পুনরায় আমজনতা তাদের পুরোনো অভ্যাসে ফায়ার যায়। এর ফলে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে খোলা স্থানে শৌচ করার প্রবণতা।
১৮৭৮ সালে প্রথম ঔপনিবেশিক ভারতে Sanitation Law প্রবর্তিত হয়। সেই সাথে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের প্রথম রাজধানী কলকাতাতে কলকাতা পৌরসভা কে দায়িত্ব দেওয়া হয় toilet নির্মাণের জন্য। ১৮৮০ র দশকে বিভিন্ন অঞ্চলে পর্দা দেওয়া toilet এর প্রবর্তন হয়। যদিও এই আইন বাস্তবে যে অতটা কার্যকরী হয়নি তা বোঝা যায় ১৮৯৬ সালে ভয়াবহ প্লেগের প্রাদুর্ভাবে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে সাধারণ মানুষের জন্য শৌচাগার বানানো বা ব্যবহার নিয়ে তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগের কথা আর বিশেষ জানা যায় না।
দেশ স্বাধীন হবার পর অন্যান্য নানা বিষয়ের মতো গুরুত্ত্ব পেয়েছে শৌচাগার নির্মাণ ও পরিবেশের সুরক্ষার মতো বিষয়গুলি। জনসচেতনতা বাড়াতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন্ সরকারি উদ্যোগ।তবু কাজ বাকি অনেক এখনো।আশা রাখি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শ্বাস নেবে নির্মল মুক্ত শৌচবিহীন পরিবেশে ঠিক যেমন নিতো আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে।
No comments:
Post a Comment