কখনো কখনো মনে হয় ফিরে তাকাই আর সেই তাড়নাতেই হঠাত এই অনুসন্ধান। রসদ সে ভাবে সংগৃহীত হয় নি তবু যেটুকু পেয়েছি তাতে যে গৌরবময় আঞ্চলিক ঐতিঝ্হের সন্ধান পেয়েছি তার স্বাদ থেকে যাতে আমার বন্ধুরা বঞ্চিত না হন তার জন্যই এই অপটু হাতে কলম ধরা।
১৮৩৪ সালে রামলোচন রায় এর বংশধর রাজা রাজনারায়ণ রায়বাহাদুর প্রতিষ্ঠা করেন আন্দুল রাজবাড়ি। যদিও আন্দুল রাজপরিবারের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রামচরণ রায় যার সময়কাল বিচার করলে দেখা যায় পলাশীর যুদ্ধের ও আগের ঘটনা। রামচরণ রায় এর আদি বংশপরিচয় পর্যালোচনা করলে জানা যায় তিনি আন্দুলের প্রাচীনতম জমিদার পরিবার দত্তচৌধুরি বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। কাশীশ্বর দত্তচৌধুরির জামাতা গৌরিশংকর বসু মল্লিক আন্দুলে প্রতিষ্ঠা করেন মল্লিক পরিবার। গৌরিশংকর তার ভগ্নিপতি ভুবনেশ্বর কর কে আন্দুলে কর বংশ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। দত্তচৌধুরিদের ঐশর্য ও প্রতিপত্তি এই দুটি পরিবারের উত্থানে অনেকাংশে সাহায্য করেছিল। কর পরিবার তাদের নিজ উদ্দ্যোগে সেই গৌরব অনেকাংশে বৃদ্ধি করেন এবং তত্কালীন বাংলার নবাব এর কাছ থেকে রায় উপাধি লাভ করেন। খ্যাত হন রায় পরিবার হিসেবে। রামচরণ রায় তাঁর বুদ্ধিমত্তা,প্রতিভা ও পারাদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে অচিরেই নিজের অবস্থান উন্নত করেছিলেন। তিনি তত্কালীন দরবারী ভাষা ফার্সি তে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং আইনি ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন। এই সময় দিল্লি তে মোঘল রাজশক্তি যখন সকল অর্থেই অস্তাচলগামী এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলি নিজ সম্পদে পুষ্ট হয়ে নিজ নিজ ক্ষমতা বিস্তারে উদ্যত তখনি বাংলার সমুদ্রতীরে অন্যান্য বিদেশী শক্তির পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাণিজ্যের পসরা নিয়ে হাজির হলো ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই দেশে তাদের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের প্রথম সোপান ছিল রামচরণ রায় এর মত স্থানীয় প্রভাবশালী গোমস্তা, নায়েব, বেনিয়া, মহাজন, মোক্তাররা যারা এই বিদেশী বনিক্শক্তি কে স্থানীয় রাজশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে প্রভূত সাহায্য করে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের ফলস্বরূপ রামচরণ রায় এর সৌভাগ্য বৃদ্ধি হতে থাকে। আন্দুল রাজপরিবারের মানমর্যাদা প্রভূত পরিমানে বিস্তার লাভ করে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয় লাভের পর। ইংরেজ অনুগত রামচরণ রায় দেওয়ান হন এবং ফলস্বরূপ ওই অঞ্চলের প্রতিপত্তিশালী জমিদার রূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। বাংলার সম্পদ্ নিষ্কাশন ও শোষন হেতু যে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপন করেছিল তাতে স্থানীয় প্রশাসনে দেওয়ান দের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রামচরণ রায় এর পুত্র রামলোচন রায় ও ছিলেন পন্ডিত এবং বিদ্বান। তিনি লর্ড ক্লাইভ এর থেকে রাজানুগত্ত ও বিশ্বস্ততার পুরস্কারস্বরূপ একটি বড় কামান উপহার পেয়েছিলেন যেটি আন্দুল রাজবাড়িতে সংরক্ষিত হয়। তাঁর আমলে হুগলী থেকে বহু পন্ডিত,চিকিত্সক,শিক্ষককে নিষ্কর জমি প্রদান করে বসতি স্থাপন করানো হয়। ব্রিটিশ শক্তির ভরকেন্দ্র কলকাতার নিকটবর্তী সরস্বতী নদিপুষ্ট আন্দুল ক্রমেই একটি সম্মৃদ্ধ জনপদ হয়ে ওঠে। কাশীনাথ রায় এর আমলে বর্ধমান রাজবাড়ির আদলে ধীরেধীরে নির্মিত হতে থাকে এই আন্দুল রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন জমিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অন্নপূর্ণা মন্দির ও চৌদ্দ শিবলিঙ্গ মন্দির। ১৭৭০ সালে রাজ্নারায়ান রায় বাহাদুর রাজবাড়ির পিছনের প্রাঙ্গনে সুরু করেন দুর্গাপূজা। দুর্গাপ্রতিমা সরস্বতী নদীতে মহাধুম্ধামের সঙ্গে নিরঞ্জন করা হত। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত রাজপরিবারের দুর্গাপুজাতে তোপ দাগা হত। তাঁর আমলেও ইংরেজদের সঙ্গে আন্দুল রাজপরিবারের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। লর্ড অকল্যান্ড তাঁকে রাজা উপাধি প্রদান করেন। তাঁর আমলে অন্নপূর্ণা মন্দির বা তত্কালীন ভুকাশী মন্দিরের নির্মান সম্পূর্ণ হয়। অন্নপূর্ণা দেবী ও নটশিব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৪৫ এ সমাচার চন্দ্রিকাতে এই নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শ্রী জ্ঞানেন্দ্র কুমার সংকলিত বংশপরিচয় (আন্দুল রাজবংশ) তৃতীয় খন্ড থেকে জানা যায় মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় মহোতসবের কথা। সেই উত্সবে তোপধ্বনি, আতশবাজি প্রদর্শনী থেকে শুরু করে সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ সহযোগে ইংরেজি বাদ্যযন্ত্র এর ব্যবহার ও সব শেষে কৃষ্ণলীলা যাত্রাভিনয় সহ বিপুল মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা ছিল যা থেকে সেই সময় রাজপরিবারের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির কথা অনুমান করা যায়। মন্দিরে এখনো রাখা আছে সেই আমলের কামান। এখনো এই রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন হয় তবে পূর্বের সেই আরম্বর আর নেই। সামনের মাঠে পুজোর কয়দিন স্থানীয় মেলা বসে। ১৮৩৫ সালে রাজনারায়ণ এর সময়ই এই রাজবাড়ি নির্মান সম্পূর্ণ হয়। প্রায় ১০ বিঘা জমির উপর স্থাপিত এই রাজবাড়ির ১০০টি ঘর ছিল। সমগ্র প্রাসাদ ছিল বেলোয়ারি ঝারবাতিতে সুসজ্জিত। ছিল হাতে টানা পাখা ও তার জন্য পান্খাপুলার। ছিল নাচঘর।.সন্ধেবেলা বসত আসর। ১৯৬২ সালে গুরু দত্ত পরিচালিত মীনাকুমারী, গুরু দত্ত এবং ওয়াহিদা রহমান অভিনীত ‘সাহেব বিবি আউর গুলাম’ এর দীর্ঘদিন শু্টিং হয়েছিল আন্দুল রাজবাড়িতে। বহু চলচিত্র , টেলিফিল্ম, বিজ্ঞাপনের কাজ হয়েছে এই রাজবাড়িতে। শুটিং করেছেন স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। আজ আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। কালের রথচক্রে অতীতের গৌরব আজ স্মৃতিমাত্র। সেখানে গেলে এখন অন্নপূর্ণা মন্দিরে নাচের স্কুল মূল ভবনে ক্লাব ঘর,সেলাই স্কুল বা প্রাইমারী স্কুল চলছে দেখা যায়। ভেঙ্গে পরেছে মূল ফটক,নাচ ঘর এর অনেকাংশ। প্রশাসনিক উদ্যোগেই সম্ভব এই ঐতিজ্ঝের রক্ষনাবেক্ষণ। আপাতত অপেক্ষা সেই উদ্যোগের বাস্তবায়নের জন্য।
তথ্যসূত্র:-
আনন্দবাজার
Times of India
Wikipedia
আমার দেশের কথা -অতুল কৃষ্ণ দত্তচৌধুরী
Dutta Vansa Mala by kedarnath dutta
Bonediporibarer Ghor Bari-Ananda Publishers
ইন্দ্রানী মজুমদার
অলিন্দ
সিংহদুয়ার
খিড়কি থেকে
নাচঘর
অন্নপূর্ণা মন্দির
রাজবাড়ি
Good article! Liked it!
ReplyDeletethank you :)
ReplyDelete