Wednesday, 29 July 2015

জব চার্নক ও উলুবেড়িয়া




বেশ কয়েকবছর হলো পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক কর্মকান্ডের মুখ্য প্রাণকেন্দ্র কলকাতার ঐতিহ্যবাহী রাইটার্স বিল্ডিং থেকে স্থানান্তরীত হয়েছে গঙ্গাপারের অপর শহর হাওড়ায় টাইম মেশিন চড়ে যদি কয়েক শতক পেছনে যাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে , যদি ইতিহাসের কিছু রদবদল হত তাহলে কলকাতার পরিবর্তে হয়ত হাওড়াই  হয়ে উঠত ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম প্রশাসনিক সদর দপ্তর , যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকত শহর উলুবেরিয়া
অবাক হলেন তো !!!....তাহলে ফিরে যেতে হবে সেই সময়ে যখন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বনিকের বেশ ছেড়ে রাজদন্ড গ্রহণ করেনি I সময়টা পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধ। সেই সুদূর ইউরোপ থেকে ভারতের উপকূল জুড়ে প্রতিদিনই ভিড় করছে  নানা বাণিজ্যসম্ভারে সুসজ্জিত বাণিজ্যতরী যার অধিকাংশই পর্তুগাল কিংবা হল্যান্ডের। তখনও হলে পানি পায়নি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই সময় ভারতীয় বাজারে তাদের বিনিয়োগের পরিমান ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক-দশমাংশ।আর হবে নাই বা কেন। ইংল্যান্ড তখন ঘরে-বাইরে যুগপৎ আক্রমণে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। একদিকে গৃহযুদ্ধ আর অন্যদিকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে নাজেহাল লন্ডনের কর্তৃপক্ষ একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলা থেকে ব্যবসার পাটতারি গোটানোর। 
কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। পরবর্তী শতকে বিশ্ব-রাজনীতিতে ক্রমেই শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে ইংল্যান্ড।অপরদিকে ভারতে মোঘলশক্তি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে সাম্রাজ্যের ওপর। দিল্লির মসনদের দুর্বলতার সুযোগে মাথাচাড়া দিয়েওঠে প্রাদেশিক শক্তিসমূহ। এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থার সুযোগে ভারতীয় রাজনীতির মুক্তমঞ্চে অবাধে অনুপ্রবেশ ঘটে ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠীর।
এমনই এক অস্থির সময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় তাদের প্রথম ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করে সালটা ১৬৫১ বাংলায় তাদের আর্থিক কার্যকলাপের শুরুটা ছিল খুবই সীমিত সেই অর্থে কোম্পানির তরফে তেমন লাভজনক ছিল না ১৬৬০ সালের পর দ্বিতীয় চার্লসের ইংল্যান্ড ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের পর অবস্থার উন্নতি ঘটে এইসময় বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি তথা পরিদর্শক হিসেবে মাদ্রাজ থেকে পাঠানো হয় উইলিয়াম হেজকে  তিনিব্যবসার স্বার্থে ঢাকায় গিয়ে সাক্ষাত করেন তত্কালীন বাংলার দোর্দন্ডপ্রতাপ শাসক সায়েস্তা খাঁর সঙ্গে। কিন্তু ব্যর্থ হন তেমন কোনো লাভজনক প্রতিশ্রুতি আদায়ে ।এছাড়া ব্যবসা চালাতে গিয়ে স্থানীয় মোঘল কর্মচারীদের অতিরিক্ত অর্থাদায়  আইনের শাসনের অভাব নিয়েও তিনি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর ক্ষোভ উগরে দেন এমতাবস্থায় ইংরেজ সরকারের অনুমতি ক্রমে কোর্ট অফ ডিরেকটর্স নির্দেশ দেন সশস্ত্র আক্রমনের 

সাল ১৬৮৬জব চার্নক এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন I তিনি প্রথমে চন্দননগর আসেন তারপর ক্যাপ্টেন অর্বুনথের সাহায্যে হুগলির ফৌজদার কে পরাস্ত করেন যুদ্ধের পরিনাম স্বরূপ  মোঘল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ  ইংরেজদের তুলনায় ছিল অনেক বেশি ইংরেজদের হুগলী দখলের খবর শুনে সায়েস্তা খান ইংরেজদের বন্দী করার জন্য বড় অশ্বারোহী বাহিনী পাঠান I খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ ইংরেজরা সকল কিছু নিয়ে হুগলী ছেড়ে ঘাঁটি গড়েসুতানুটিতে এরপর একে একে ব্রিটিশ সৈন্য জব চার্ণকের নেতৃত্বে কলকাতায় গার্ডেন রিচের দুর্গ, হিজলী দুর্গ, রসুলপুরের কিছু অংশ উড়িষ্যায় বালাসরের ২টি দুর্গ দখল করেন এরপর সায়েস্তা খাঁর নির্দেশে আব্দুস সামাদের নেতৃত্ত্বাধীন বাহিনী হিজলী থেকে ইংরেজদের বিতারিত করেন কিন্তু অপরদিকে ইংরেজদের বিতারিত করার দরুন মোঘল রাজকোষে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি হতে থাকে তাই মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে সায়েস্তা খান ১৬৮৭ সালের ১৬ই অগাস্ট কলকাতা থেকে ২০ মাইল দুরে অবস্থিত উলুবেরিয়াতে ইংরেজদের বসতি স্থাপন বাণিজ্যের অধিকার দেন
গঙ্গাপাড়ের এই অখ্যাত জনপদ উলুবেড়িয়া ইংরেজদের প্রথম ঘাঁটি হলেও সেখানে ইংরেজ বসতি হাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জব চার্নক উলুবেড়িয়াতে কুঠি ও ফোর্ট সেন্ট জর্জ দুর্গ প্রতিষ্ঠার প্রশাসনিক অনুমোদন পেলেও স্থানীয় জনগণ নবাব সরকারের কাছে এই মর্মে ক্ষোভ প্রকাশ করে যে গঙ্গা তীরে ইংরেজ কুঠি থাকলে মেয়েদের আব্রু রক্ষা করা যাবে না।অপরদিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে হলেওবেঙ্গল কাউন্সিলও উলুবেড়িয়ার বদলে সুতানুটির পক্ষে মত প্রকাশ করে লেখেন -"Our General Letter by the Beaufort and Diaris of that year where in we have laid down our reasons for the altering our opinion about Ulubarreah and pitching on Chuttanuttee as the best and fittest up the river on the Maine, as we have since experienced and like-wise been satisfied that Ulubarreah was misrepresented to us by those sent to survey it". 
ফলস্বরূপ জব চার্নক কিছুদিনের মধ্যেই উলুবেরিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন ১৬৮৭ সালে ফিরে এলেন সুতানুটিতেরচিত হলো কলকাতা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় ব্রাত্য  হলো উলুবেড়িয়া বঞ্চিত হলো উলুবেড়িয়ার ইতিহাস

ঘাঁটি-বদলের এই সিদ্ধান্তকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেছিলেন  নিজেও। দূরদৃষ্ট দক্ষ প্রশাসক হিসেবে জব চার্নক অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে বুঝেছিলেন জনবিরল এই উলুবেড়িয়া শহর বাণিজ্যিক ভাবে ইংরেজদের পক্ষে লাভজনক হবে না তত্কালীন সময় উলুবেড়িয়া  ছিল উলুবনে ঘেরা,জলা জঙ্গলমপুর্ণ নদীর নাব্যতা ছিল কম তাই বানিজ্যের প্রয়োজনে বড় জাহাজ বা নৌকো চলাচলে অসুবিধা হতো।সেই তুলনায় ইংরেজদের পক্ষে তত্কালীন সুতানুটি বা কলকাতা ভৌগলিক বা কৌশলগত দিক দিয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক জায়গায় ছিল ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী যথার্থই বলেছেন যে ভিনদেশ থেকে আগত এই ব্যক্তির কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তিনি শুধুমাত্র ব্রিটিশদের স্বার্থই দেখেছিলেন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মোঘল শক্তির  দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ বাণিজ্যের বিকাশ ঘটানো এবং সেদিক থেকে তিনি সঠিক ভাবেই অনুধাবন করেছিলেন যে সবদিক দিয়ে কলকাতার তুলনায় উপযুক্ত বিকল্প উলুবেড়িয়া হতে পারে না এছাড়া কলকাতার কাছেই ছিল গঙ্গার ওপর পারের জনপদ বেতর যা ইউরোপীয় শক্তির আদিকেন্দ্র যেখানে জাহাজ মেরামতির সুব্যবস্থা ছিল ভালো নোঙ্গর পাওয়া যেত। A Historical and Topographical Sketch of Calcutta প্রনেতা H.G .Rainy র অনুমানও এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। তিনি দেখিয়েছেন যে গঙ্গার পশ্চিম কুল স্বাস্থ্যকর হলেও সেখানে মারাঠা আক্রমনের আশঙ্কা ছিল যথেষ্ট যেটি উলুবেড়িয়া পরিত্যাগের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।। বাংলার পশ্চিমাংশে আক্রমন্ রত মারাঠা বাহিনীর থেকে  সুতানটি বা কলকাতা গঙ্গা নদীর উপস্থিতির কারণে নিরাপদ্ প্রাকৃতিক ভাবে সুরক্ষিত অঞ্চল ছিল এছাড়া কাছাকাছি কোনো মোঘল দুর্গ ছিল না সেই সময় এই অঞ্চলে জমির দাম ছিল যথেষ্ট কম সুতানটি, গোবিন্দপুরে সমসাময়িক কালে গঙ্গার পশ্চিমপাড় অপেক্ষা জনবসতিও ছিল বেশি ফলে অল্প খরচে শ্রমিক চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়েছিল। ধীরে ধীরে দেশীয় মহাজনরাও বসতি স্থাপন শুরু করেছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম এর কাছে গোবিন্দপুরে। এই সবকিছুর সহাবস্থানে কলকাতা নগরকে কেন্দ্র করে ফুলে ফেঁপে ওঠে ব্রিটিশ বানিজ্য। প্রাণ ফিরে পায় কলকাতার অর্থনীতি যা জন্ম দিয়েছিলো ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজধানী-শহর কলকাতার । তাই জব চার্নক কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও কলকাতার বিকাশে তার যোগ্য অবদান অনস্বীকার্য

তথ্যসূত্র
  1. Myth And Reality About A City’s Foundation – Sushil Chaudhury
  2. কৌশিকী-তারাপদ সাঁতরা
  3. History of Bengal (v.II) - Muslim Period 1200-1757 ADSir Jadunath Sarkar and Ramesh Chandra Majumdar (ed)
  4. Howrah Jelar Itihas-Achal Bhattacharyya

                                                                                                        ইন্দ্রানী মজুমদার