কর্মসূত্রে হাওড়া জেলায় কাজ করতে গিয়ে হঠাতই নজরে পড়েছিল এক ব্যক্তি র ঠিকানা যেটা দেখে আপনাদের মতই আমিও কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিকানাটি ছিল খানিকটা এই রকম- নিবাস-গ্রাম কলিকাতা-রসপুর থানা-আমতা জেলা-হাওড়া। উত্সাহ জন্মায় স্থানটি সম্পর্কে। খোঁজাখুজি করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রাক-ঔপনিবেশিক বা ঔপনিবেশিক বাংলার কিছু অজানা তথ্য। তুলে দিলাম আপনাদের হাতে আরো সমৃদ্ধ হবার আশায়।
আমতা থানার অনতিদূরে দামোদরের তীর ঘেষা এই ছোট্টো গ্রাম যাকে স্থানীয় লোকেরা ছোটো কলিকাতা বলে থাকেন। পার্শবর্তী রসপুর গ্রামের সঙ্গেই এর নাম উচ্চারিত হয় একত্রে রসপুর-কলিকাতা নামে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা নামের উত্স সন্ধান করতে গিয়ে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বাংলাদেশে আরো দুইটি কলিকাতা নামক স্থানের সন্ধান পান যার একটি বাংলাদেশে ঢাকা জেলার অন্তর্গত লৌহজং থানা অধীনস্থ কলিকাতা-ভোগদিয়া অপরটি আমাদের আলোচ্য স্থান। ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে ১ম সংখ্যা সাহিত্য পরিষত পত্রিকা তে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ থেকে জানা যায যে কলিকাতা একটি খাঁটি বাংলা শব্দ। কলি বা কলি চুনের জন্য কাতা বা শামুক পোড়া থেকেই কলিকাতা নাম হয়েছে। সুতার নুটি বা গোলার হাট বা গুদাম থেকে যেমন সুতানুটি র নাম তেমন ই কলির বা চুনের ও কলিচুনের জন্য শামুকের আড়ত এবং চুনের কারখানা থেকে কলিকাতা নাম হয়েছে। গ্রাম কলিকাতার নামকরণ প্রসঙ্গে বিরুদ্ধ মত ও শোনা যায়। অনেকে বলেন ইংরেজরা কলিকাতা গ্রামে নীলের চাষ করতে এসে এখানে একটি কুঠিবাড়ি নির্মান করেন এবং শহর কলিকাতার নামানুসারে গ্রামের নাম রাখেন কলিকাতা। যদিও এই মত সমর্থন যোগ্য নয় কারণ পলাশীর যুদ্ধের বেশ কয়েক দশক পর বাংলার গ্রামাঞ্চলে
নীল চাষের প্রসার শুরু হয়। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের বহুপূর্বেই এই কলিকাতা গ্রামের নামের সন্ধান পাওয়া যায়।আইন-ই-আকবরী তে কলকত্তা শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। রসপুর গ্রামের শিবায়ন কাব্য প্রনেতা রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্রের পুত্র জগন্নাথ রায় কে বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরাম রায় ১০৯১ বঙ্গাব্দে যে সনদপত্র দেন তাতে কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ আছে। ১১৬৯ বঙ্গাব্দে কলিকাতা গ্রামবাসী ক্ষুদিরাম দয়াশী এবং ১১৮৫ বঙ্গাব্দে উক্ত গ্রামের আত্মারাম বনিকের স্বাক্ষর সম্বলিত দলিল পাওয়া গেছে যা থেকে প্রমান হয় ইংরেজদের আগমনের অনেক আগেই গ্রামের নাম কলিকাতা হয়েছিল। ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের
সংস্কৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে " এক সময় কলিচুনের কাতা
বা আড়ত থেকেই ভাগীরথীর পূর্বে ও পশ্চিমে দুটি গ্রামের নাম কলিকাতা হয়েছিল। পূর্ব তীরের গ্রামটি ব্রিটিশ শাসকদের প্রয়োজনে গ্রাম থেকে নগর ও মহানগরে পরিনত হয় প্রায় দুশ বছর ধরে , আর পশ্চিমতীরের দামোদর সংলগ্ন গ্রামটি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকে। "খাস কলকাতাতেও একসময় চুনারীরা বসবাস করত এবং চুন ও চুনারীদের নামে কলকাতার কয়েকটি এলাকা পরিচিত হয়েছিল যেমন চুনাপুকুর লেন, চুনাগলি, চুনার পাড়া লেন। এই সমস্ত স্থান ই ছিল ভাগীরথীর তীরে।যদিও শহর কলিকাতা নামের উদ্ভবের অনেক তত্তই আছে। অনেকে মনে করেন কালীক্ষেত্র থেকে নামটি এসেছে। বিপ্রদাস বিরচিত মনসামঙ্গলে উল্লেখ আছে চাঁদ সদাগর সপ্তগ্রাম যাবার পথে কালিঘাটে পূজা নিবেদন করেছিলেন কালিমা কে।মুকুন্দরাম বিরচিত চন্ডিকাব্য ও গঙ্গাভক্তি তেও কালিঘাট এর উল্লেখ আছে। আবার অনেকে মনে করেন এই অঞ্চল কিলকিলা যার অর্থ সমতল অঞ্চল ছিল বলে এই নামের উত্পত্তি হয়েছিল। অনেকের মতে কাটাখাল পার্শবর্তী অঞ্চল বলে কলিকাতা নাম হয়েছে। তবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মত অনুসরণ করলে আমতা র এই অখ্যাত গ্রামের সঙ্গে মহানগরীর যে যোগসূত্র স্থাপন করা যায় তা ইতিহাসের নিরব দর্শক হিসেবে আমার কাছে বেশ উত্সাহজনক মনে হয়েছে।
নদীর এপাড়-ওপাড় |
২০১১ সালের জনগননা তথ্য অনুসারে এই গ্রামের village code -332637 I এই গ্রাম এ প্রথাগত জীবিকা নির্বাহ করেছেন এমন কিছু চুনারী পরিবার আজ খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে উন্নত নির্মান
প্রযুক্তি ও সিমেন্ট ব্যবহারের যুগে চুনের চাহিদা ফুরিয়েছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে কমেছে চুন উত্পাদন ও।
তথ্যসূত্র :-
১. আমার বাংলা-কলিকাতা গ্রামের ঐতিহ্য - পাঁচুগোপাল রায়
২.হাওড়া জেলার পঙ্খের কাজ- শিবেন্দু মান্না
৩.পশ্চিমবঙ্গের
সংস্কৃতি -বিনয় ঘোষ
৪. কলিকাতা নামের ব্যুত্পত্তি -সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়